ক্ষুদ্র মূল্যমানের কয়েনের অন্তর্ধান: একটি বৈশ্বিক প্রবণতা
ক্ষুদ্র মূল্যমানের কয়েনগুলি ধীরে ধীরে প্রচলন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, যার পেছনে আছে মুদ্রাস্ফীতি, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল পেমেন্টের প্রতি অভ্যস্ততা। ক্ষুদ্র কয়েনগুলো বাজার থেকে উঠে যেতে থাকায়, সংগ্রাহকদের কাছে এদের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে, ইতিহাস সংরক্ষণের আগ্রহীদের জন্য এটি একটি রোমাঞ্চকর সুযোগও সৃষ্টি করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রেজারিকে নতুন পেনি উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন, একে অপচয় বলে উল্লেখ করে। ইউএস মিন্টের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, এক সেন্টের কয়েন উৎপাদন ও বিতরণে খরচ হয় ৩.৬৯ সেন্ট। এলন মাস্কের গঠিত সরকারী দক্ষতা বিভাগের মূল্য সংক্রান্ত উদ্বেগের সূত্র ধরে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, ক্ষুদ্র কয়েন শুধুমাত্র সম্পদের অপচয় করে, তবে সমর্থকরা মনে করেন এগুলি দাম কম রাখতে এবং দাতব্য কাজে সহায়তা করে। এই সিদ্ধান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাড়তে থাকা সেই দেশের তালিকায় যুক্ত করেছে যারা ক্ষুদ্র মূল্যমানের কয়েন বাতিলের দিকে এগোচ্ছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ক্ষুদ্র কয়েন দৈনন্দিন লেনদেনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ ও নিখুঁত খুচরো ফেরত পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক অদক্ষতা, উৎপাদন ব্যয় ও ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ ক্রমান্বয়ে এই সামান্য মূল্যমানের কয়েনগুলো ব্যবহার বন্ধ করছে। তবে এটি কয়েন সংগ্রাহক ও নিউমিস্ম্যাটিস্টদের জন্য কী বোঝাচ্ছে?
কেন ক্ষুদ্র কয়েনগুলো উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ক্ষুদ্র মূল্যমানের কয়েন তুলতে ভূমিকা রাখছে:

১. উচ্চ উৎপাদন খরচ – অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র কয়েন উৎপাদন ও বিতরণের খরচই কয়েনের মূল্যমাত্রার চেয়ে বেশি। কোথাও কোথাও এক বা দুই সেন্টের কয়েন তৈরী ও প্রচলনে তার আসল মূল্যের দ্বিগুণের বেশি খরচ হয়। এ কারণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও এদের বিলুপ্ত করছে সরকারগুলো।
২. মুদ্রাস্ফীতি ও কমে যাওয়া ক্রয়ক্ষমতা – সময়ের সাথে সাথে মুদ্রাস্ফীতির ফলে ক্ষুদ্র কয়েনগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, ফলে দৈনন্দিন লেনদেনে এসবের আর ব্যবহার নেই বললেই চলে। যা আগে ছোট কিছু কেনাকাটায় চলত, এখন তা প্রায় মূল্যহীন। সংগ্রাহকদের কাছে এই কয়েনগুলো এখন গোপন রত্ন হিসেবে তার ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ফুটিয়ে তোলে।
৩. নগদহীন লেনদেনের উত্থান – ডিজিটাল পেমেন্ট, ক্রেডিট কার্ড আর মোবাইল ওয়ালেট ব্যবহারের বিস্তারে নগদ, বিশেষত ক্ষুদ্র কয়েনের ওপর নির্ভরতা অনেক কমে গেছে। বেশিরভাগ বিক্রেতা লেনদেন ৫ বা ১০ সেন্টের কাছাকাছি রাউন্ড করে ফেলে, ফলে সামান্য মূল্যমানের মুদ্রার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কিন্তু সংগ্রাহকদের জন্য, এটি এ কয়েনগুলোকে সংরক্ষণ ও নথিবদ্ধ করার সেরা সুযোগ তৈরি করেছে।
৪. পরিবেশগত দিক – ধাতব কয়েন উৎপাদন ও খনন পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এতে প্রাকৃতিক সম্পদ ফুরিয়ে যায় এবং শক্তি খরচ বাড়ে। ক্ষুদ্র কয়েন বন্ধ করলে সরকারগুলো পরিবেশগত ধাক্কা কমাতে পারে। সংগ্রাহকদের কাছে বিলুপ্তপ্রায় এসব সংখ্যা ধরে রাখা আরো বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে।
যেসব দেশ ক্ষুদ্র কয়েন তুলে দিয়েছে
অনেক দেশ ইতিমধ্যে ক্ষুদ্র মূল্যমানের কয়েন বন্ধ করেছে কিংবা তা তুলতে চলেছে:

- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – সদ্য পেনি উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে উৎপাদন ব্যয় নিয়ে উদ্বেগের প্রেক্ষিতে।
- কানাডা – ২০১৩ সালে এক সেন্টের কয়েন তুলে দিয়েছে, এখন নগদ লেনদেন ৫ সেন্টের ঘরে রাউন্ড হয়। এরপর পেনি সংগ্রাহকদের কাছে দুষ্প্রাপ্য (আরো পড়ুন: "Phasing out the penny")।
- অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড – ১৯৯০-এর দশকে ১ ও ২ সেন্টের কয়েন তুলে দিয়েছে, ফলে বাজারে আরও কম মিলছে (আরো পড়ুন: "২৫ বছর পূর্তি: অস্ট্রেলিয়ার ১ ও ২ সেন্ট কয়েন প্রত্যাহার")।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন – কিছু ইউরোজোন দেশের মধ্যে ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস ১ ও ২ সেন্ট ইউরো কয়েন বন্ধ করেছে, বদলে নিয়েছে রাউন্ডিং নীতি। সংগ্রাহকদের কাছে এই কয়েনগুলো এখন দুষ্প্রাপ্য (আরো পড়ুন)।
- সুইডেন ও নরওয়ে – একাধিক ছোট মূল্যমানের কয়েন তুলে দেয়া হয়েছে এবং দেশগুলো দ্রুত নগদহীন অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে, ফলে বিলুপ্ত কয়েন নিউমিস্ম্যাটিস্টদের কাছে আকর্ষণীয় হচ্ছে।
- যুক্তরাজ্য – ১ পেনি ও ২ পেনি এখনো চালু থাকলেও, ২০২৪ সালে নতুন কয়েন মুদ্রিত হয়নি, নগদ ব্যবহারের হার কমে যাওয়ায় (আরো পড়ুন)।
সংগ্রাহক ও কয়েনপ্রেমীদের জন্য প্রভাব
ক্ষুদ্র মূল্যমানে কয়েন বন্ধের কিছু মিশ্র প্রভাব রয়েছে:
- বাড়ছে দুষ্প্রাপ্যতা ও সংগ্রহযোগ্যতা – প্রচলন থেকে উঠে যেতে থাকায়, সংখ্যায় কমে যাওয়া এসব কয়েনের মূল্য ও সংগ্রহযোগ্যতা বেড়ে যায়। আগে সহজলভ্য থাকা কয়েন হঠাৎই আকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে সংগ্রাহকদের হাতে।
- বাজারমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা – প্রচলনবিহীন কয়েনগুলো সময়ের সাথে নিজেদের বাজারমূল্য বাড়াতে পারে। এখন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করলে ভবিষ্যতে এগুলো দামি সম্পদ হয়ে যেতে পারে।
- ঐতিহাসিক ও শিক্ষামূল্য – অনেক ক্ষুদ্র কয়েনের নকশা, ইতিহাসের চরিত্র বা সাংস্কৃতিক চিহ্ন থাকে। এগুলো সংরক্ষণ মানে অতীতের স্পর্শযোগ্য ইতিহাস বজায় রাখা।
- কয়েন শনাক্তকরণ সহজ – কয়েনোস্কোপ -এর মতো অ্যাপ দিয়ে সংগ্রাহকরা সহজেই ছবি তুলে কয়েন শনাক্ত করতে পারেন, মূল্য নির্ধারণ করতে পারেন। ফলে এখন ছোট মূল্যমানের কয়েন সহজেই ক্যাটালগ ও মূল্যায়ন করা সম্ভব—দুর্লভ হয়ে ওঠার আগেই।
ক্ষুদ্র কয়েন এবং নিউমিস্ম্যাটিক্সের ভবিষ্যৎ
ডিজিটাল পেমেন্টে অভ্যস্ততা বাড়তে থাকায় চালু নগদ অর্থের ধরন বদলে যাচ্ছে। বড় মূল্যমানের নোট-সিকি কিছুদিন চললেও, ক্ষুদ্র কয়েন উঠে যাওয়া দেখাচ্ছে ডলার ব্যবহারে একটি বিস্তৃত পরিবর্তন। তবে সংগ্রাহক ও কয়েনপ্রেমীদের জন্য এটি এক নতুন দারুণ সময়! ক্ষুদ্র কয়েনের অন্তর্ধান তাদের সংরক্ষণ ও ইতিহাস ধারণের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে।
ক্ষুদ্র কয়েনের বিলুপ্তি অর্থনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক, তবে সংগ্রাহকদের কাছে এটি এক রহস্যময় নতুন অধ্যায় উন্মোচন করে। আপনি যদি শখের নিউমিস্ম্যাটিস্ট, কিংবা অভিজ্ঞ সংগ্রাহক হন, এখনই সঠিক সময় কয়েনোস্কোপ-এর মতো টুল ব্যবহার করে এই ছোট অথচ আকর্ষণীয় ইতিহাসের অংশগুলো আবিষ্কার, নথিভুক্ত ও মূল্যায়ন করার—এগুলো একসময় কেবলই অতীতের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগেভাগেই।